ড. ইউনূস: শেখ হাসিনাকে ‘ফিরিয়ে আনতে’ হবে, নয়তো..

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জোর দিয়ে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য ভারত থেকে ফেরত আনা জরুরি। বৃহস্পতিবার প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া (পিটিআই)-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউনূস জোর দিয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনীত নৃশংসতার অভিযোগের বিচার হওয়া জরুরি।

শেখ হাসিনা ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস

ঢাকাস্থ তার সরকারি বাসভবন যমুনাতে পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেন, "তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে, নাহলে বাংলাদেশের মানুষ শান্তিতে থাকবে না। তিনি যেসব নৃশংসতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তার বিচার এখানে হওয়া উচিত।"

হাসিনার ভারত থেকে দেওয়া মন্তব্যের সমালোচনা

ড. ইউনূস ভারত থেকে হাসিনার দেওয়া সার্বজনীন মন্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, এসব মন্তব্য ‘অমিত্রতাপূর্ণ’ এবং দুই দেশের মধ্যে অস্বস্তির সৃষ্টি করেছে।

গণ-আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগের পর ভারতে চলে যাওয়া হাসিনা ১৩ আগস্ট এক বিবৃতিতে আন্দোলনের সময় ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’, হত্যা এবং ভাঙচুরে জড়িতদের বিচারের দাবি করেন।

‘এটা আমাদের জন্য বা ভারতের জন্য ভালো নয়। এটা নিয়ে অস্বস্তি আছে,’ হাসিনার ভারত থেকে রাজনৈতিক আলোচনায় অংশ নেওয়ার বিষয়টিকে উল্লেখ করে বলেন ইউনূস।

তিনি পিটিআইকে বলেন, ‘যদি বাংলাদেশ (সরকার) তাকে ফেরত চাওয়া পর্যন্ত ভারত তাকে রাখতে চায়, তাহলে শর্ত এটাই হবে যে তাকে নীরব থাকতে হবে।’

ইউনূস আরও বলেন, হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ফেসবুক পেজের মাধ্যমে তার সার্বজনীন মন্তব্য সমস্যা তৈরি করছে কারণ এটি তাকে বিচারের আওতায় আনার প্রচেষ্টায় বাধা হয়ে আসছে।

‘সে চুপ থাকলে আমরা ভুলে যেতাম; মানুষও এটা ভুলে যেত কারণ সে তার নিজের জগতে থাকত,’ তিনি যোগ করেন।

‘কিন্তু ভারতে বসে তিনি কথা বলছেন এবং নির্দেশনা দিচ্ছেন। কেউ এটা পছন্দ করে না।’

ভারতের কাছে উদ্বেগ জানানো হয়েছে

বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কাছে এই বিষয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে কিনা জানতে চাইলে ইউনূস নিশ্চিত করেছেন যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মৌখিকভাবে এবং ‘খুবই দৃঢ়ভাবে’ তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে।

তিনি আবারও জোর দিয়ে বলেন, তার প্রশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের বিদ্রোহের পর পলাতক থাকা অবস্থায় হাসিনার ভারত থেকে সার্বজনীন মন্তব্য ‘অমিত্রতাপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হচ্ছে।

‘তাকে সেখানে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, এবং তিনি সেখান থেকে রাজনীতি করছেন। এটা এমন নয় যে তিনি সেখানে সাধারণ কোন কারণে গেছেন। তিনি জনগণের বিদ্রোহ এবং রাগের মুখে পালিয়ে গেছেন,’ ব্যাখ্যা করেন ইউনূস।

ভারতকে অবস্থান পুনর্বিবেচনার আহ্বান

ইউনূস ভারতকে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ভাবনা পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি সেই বিশ্বাসের সমালোচনা করেছেন যে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ছাড়া বাংলাদেশ বিশৃঙ্খলার মধ্যে পতিত হবে। নয়াদিল্লির কিছু রাজনৈতিক মহলে এই রকম একটি ধারণা প্রচার করা হচ্ছে।

ইউনূস বলেন, ‘ধারণাটি হলো সবাই ইসলামপন্থী, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ইসলামপন্থী এবং বাকিরা সকলেই ইসলামপন্থী এবং এই দেশকে আফগানিস্তান তৈরি করবে। এবং শুধুমাত্র শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ নিরাপদ হাতে আছে। ভারত এই ধারণা দ্বারা বন্দী। ভারতকে এই থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’

হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার বিষয়টি ‘অজুহাত’

তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার বিষয়ে ভারত যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তাকে তিনি ‘অজুহাত’ বলে অভিহিত করেন এবং জোর দিয়ে বলেন যে এই বিষয়গুলো কূটনৈতিক আলোচনায় অতিরঞ্জিত করা উচিত নয়।

তিনি বলেন, ‘সংখ্যালঘুদের অবস্থার এই রকম একটি বড় চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা কেবল একটি অজুহাত।’

দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ইউনূস স্বীকার করেন যে বর্তমানে সম্পর্ক চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তিনি আস্থা পুনর্গঠনের জন্য সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

তিনি বলেন, ‘আমাদের এই সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যা এখন নীচের দিকে ।’

বিতর্কিত চুক্তিগুলোর পুনর্মূল্যায়ন

ইউনূস আরও জানান যে দুই দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক চুক্তিগুলো, যার মধ্যে বিতর্কিত ট্রানজিট এবং আদানি বিদ্যুৎ চুক্তি রয়েছে, সেগুলোর পুনর্মূল্যায়ন করার জন্য বাংলাদেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দাবি রয়েছে।

ইউনূস বলেন, ‘সবাই বলছে যে এটা প্রয়োজন। আমরা দেখব কাগজে কী আছে এবং দ্বিতীয়ত, কার্যত মাঠ পর্যায়ে কী ঘটছে। যদি পুনর্বিবেচনার কোনো প্রয়োজন হয়, তাহলে আমরা এ সম্পর্কে প্রশ্ন তুলব।’

হাসিনার প্রত্যর্পণ নিয়ে জল্পনা

প্রায় এক মাস ধরে ভারতে হাসিনার উপস্থিতি বাংলাদেশে ব্যাপক জল্পনার সৃষ্টি করেছে।

তার বিরুদ্ধে কমপক্ষে ১১৯টি হত্যা মামলা চলমান থাকায় এই প্রত্যাশা বৃদ্ধি পেয়েছে যে বাংলাদেশ সরকার শীঘ্রই তার প্রত্যর্পণের জন্য চাপ দেবে।

ইউনূসের মন্তব্য এই প্রত্যাশাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে, কারণ তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং বাংলাদেশের জনগণের দাবির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য হাসিনার ফেরত আসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. ইউনূস এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে প্রথমবারের মতো উচ্চ পর্যায়ের আলোচনার কিছু সপ্তাহ পর এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলো।

আলোচনার পর ভারতের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে জানায় যে দুই নেতা জাতীয় অগ্রাধিকারের সঙ্গে মিল রেখে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার উপায় নিয়ে আলোচনা করেছেন।