অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের ব্যাপক সংস্কারের প্রস্তাব, কী আছে তাতে?

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে ব্যাপক নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন দেশের একদল অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা। দীর্ঘদিনের শাসন, প্রশাসন এবং সামাজিক বৈষম্যের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে এই উদ্যোগকে সামরিক মহলের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের প্রতিফলন হিসেবে দেখা হচ্ছে।

গত ৫ আগস্টের ছবি

‘বাংলাদেশ ভার্সন’ শীর্ষক এই নীতিমালায় জোর দিয়ে বলা হয়েছে, বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের অর্জন ও স্বীকৃতি সত্ত্বেও, দেশের সাধারণ মানুষ তাদের স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল ভোগ করতে পারছে না।

কর্মকর্তারা তাদের নীতিমালায় উল্লেখ করেছেন যে, জনসেবকরা জনগণের সেবক হিসেবে নয়, বরং প্রায়শই শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। রাজনীতিতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও নাগরিকদের চেয়ে ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। ফলে, জনগণের মধ্যে দেশের প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসা ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

বর্তমান পরিস্থিতিকে সংস্কারের এক অভূতপূর্ব সুযোগ হিসেবে চিহ্নিত করে নীতিমালায় শাসন কাঠামোকে জনগণের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করে তোলার জোর দাবি জানানো হয়েছে।

প্রস্তাবিত সংস্কারের মধ্যে যা আছে-

১. নির্বাচন এবং রাজনৈতিক সংস্কার

• ‘বাংলাদেশ ভার্সন’ নামে একটি মিশ্র নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন যা বিদ্যমান কাঠামোর সাথে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বকে সংযুক্ত করবে।
• নির্বাচনে বিদ্যমান ‘সংরক্ষিত নারী আসন’ বাতিল করে রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের প্রার্থী তালিকা নির্ধারণে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান।
• ব্যাপক রাজনৈতিক সংস্কার সম্পন্ন এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের রাজনীতি থেকে সরিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচন স্থগিত রাখা।
• এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের জন্য ২ থেকে ৩ বছরের জন্য একটি নিরপেক্ষ ও দক্ষতাসম্পন্ন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন।
• মধ্যবর্তী নির্বাচনের সুযোগ রেখে সংসদের মেয়াদ ৪ অথবা ৬ বছর করা।
• ৫০০ আসনের একটি নতুন সংসদীয় কাঠামো প্রবর্তন, যেখানে ৩০০ জন সদস্য সরাসরি নির্বাচিত হবেন এবং ২০০ জন সদস্য আসন ভাগাভাগির মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন।

২. বিচার বিভাগীয় সংস্কার

• বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যাপক সংস্কার।
• প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের বিচারকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও যোগ্যতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
• প্রার্থীদের আর্থিক ও সম্পত্তির তথ্য জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা।

৩. প্রশাসনিক সংস্কার

• প্রশাসনিক কাঠামোকে আরও জনগণমুখী করে তোলা এবং স্বেচ্ছাচারিতা প্রতিরোধের জন্য জোরালো ব্যবস্থা গ্রহণ।
• স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালীকরণ এবং জনগণের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ।

৪. শিক্ষা সংস্কার

• বৈষম্য দূরীকরণ এবং শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে সকল স্তরে শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন।
• খ্যাতিমান শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন।
• শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সকল প্রকার রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা।

৫. বৈদেশিক সম্পর্ক এবং প্রতিরক্ষা

• বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনের সাথে সঙ্গতি রেখে একটি সুসংহত ও কার্যকরী বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন।
• কৌশলগত অংশীদারিত্বকে অগ্রাধিকার দিয়ে "সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়" নীতি পরিত্যাগ।
• সশস্ত্র বাহিনীকে সময়োপযোগী করে তোলা এবং আধুনিক সরঞ্জাম সরবরাহ নিশ্চিত করা।

৬. আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংস্কার

• র‍্যাবকে পুনর্গঠন করে একটি বিশেষ পুলিশ বাহিনীতে রূপান্তর।
• আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা।

৭. অর্থনৈতিক সংস্কার

• জাতীয় অর্থনীতিতে প্রবাসী আয়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা।
• বৈদেশিক ঋণ কমানো, সরকারি খরচ কমানো, অর্থ পাচার রোধ এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।

৮. দুর্নীতি দমন এবং স্বচ্ছতা

• ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহসহ পূর্ববর্তী সরকারের সময়কালে ঘটে যাওয়া বিতর্কিত ঘটনাগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত ও ‘শ্বেতপত্র’ প্রকাশ।
• জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী সকল চুক্তি বাতিল করা।

৯. আনসার বাহিনীর ভূমিকা শক্তিশালীকরণ

• তৃণমূল পর্যায়ে শাসন ব্যবস্থা শক্তিশালী করার লক্ষ্যে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরে আনসার সদস্যদের সম্পৃক্ত করা।

অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তারা জাতির প্রতি তাদের গভীর কর্তব্যবোধের কথা ব্যক্ত করেছেন এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে অগণিত নাগরিকের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন।

তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি শক্তিশালী, আরও সমৃদ্ধ এবং ন্যায়সঙ্গত বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য এই সংস্কারগুলোকে একটি মাধ্যম হিসেবে দেখছেন।

এই প্রস্তাবগুলো সামরিক সম্প্রদায়ের যৌথ অভিজ্ঞতা এবং অন্তর্দৃষ্টির প্রতিফলন এবং এগুলো জাতি গঠনের প্রচেষ্টার ভিত্তি হিসেবে প্রস্তুত করা হয়েছে।

তারা নীতিনির্ধারকদের এই সুপারিশগুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে একটি সমৃদ্ধ এবং সমন্বিত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা যায়।