প্রায় সাত বছর আগে প্রধান বিচারপতির পদে থাকাকালীন জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল বলে অভিযোগ করেছেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তিনি বলেছেন, সরকার যদি তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, তাহলে তিনি বাংলাদেশে ফিরে এসে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলাই যে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও সাজানো তা প্রমাণ করতে তিনি প্রস্তুত।

surendra kumar sinhaবিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা

গত ১৪ আগস্ট ভিডিও কলে এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে ফিরে যাব। আমি এখন সবুজ সংকেতের অপেক্ষা করছি।’ সাক্ষাৎকারটি আজ তাদের অনলাইন ভার্সনে প্রকাশ করা হয়েছে।

বিচারপতি সিনহা, যিনি এস কে সিনহা নামেও পরিচিত, বর্ণনা করেন কিভাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে প্রচণ্ড চাপের মুখে রেখেছিলেন এবং ‘তিনি (সিনহা) প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ও হস্তক্ষেপ উপেক্ষা করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন’ বলে ডিজিএফআই কর্মীদের মাধ্যমে তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন।

২০১৫ সালের জানুয়ারিতে দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর কুখ্যাত চোরাচালানকারী এবং দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের জামিন প্রদান থেকে নিম্ন আদালতগুলোকে বিরত রাখার জন্য তিনি কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার পর থেকেই দুজনের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়, দাবি করেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতি।

২০১৭ সালের জুলাইয়ে নির্বাহী বিভাগের পরিবর্তে সুপ্রিম কোর্টের হাতে ক্ষমতা রেখে নিম্ন আদালতের বিচারকদের জন্য শৃঙ্খলামূলক বিধি তৈরির জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন এবং ১৬তম সংশোধনী (সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণ) মামলার রায় সরকারের পক্ষে দিতে অস্বীকৃতি জানান বিচারপতি সিনহা, যার ফলে এই দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছে।

‘বাংলাদেশে আমার শেষ দিনগুলো ছিল খুবই ভয়াবহ, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কারণ এটি উপলব্ধির বিষয়। ভাবুন, একজন কার্যরত প্রধান বিচারপতিকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হতো না। আমার ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। কাউকে আমার সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হতো না। নিরাপত্তা বাহিনী (গোয়েন্দারা) আমার বাড়ির চারপাশে পাহারা দিত। আমার একজন কর্মীকে আমার বাড়িতে প্রবেশ করার সময় মারধর করা হয়েছিল। ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন প্রধান সাইফুল আবেদীন মধ্যরাতে আমাকে বিরক্ত করতেন এবং পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতেন।’

তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের তার সহকর্মীরা (বিচারক) সরকারের প্রভাবে তার সঙ্গে আদালতে বসতে অস্বীকৃতি জানান এবং তাকে জানান যে হাইকোর্টের বিচারকরা তার সঙ্গে সহযোগিতা করবেন না, যা তাকে প্রচণ্ড মানসিক চাপের মুখে ফেলে দেয়।

‘তখন আমার মনে হয়েছিল এই দেশে থাকার আর কোনো অধিকার আমার নেই।’

২০১৭ সালের ৩ জুলাই, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সিনহার নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ রায় দেন এবং সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী বাতিল করে দেন। এর ফলে অযোগ্যতা বা অসদাচরণের জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা হারায় সংসদ। প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের দুই সিনিয়র বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আবারও এই ক্ষমতা ফিরে পায়।

বিচারপতি সিনহা বলেন, আগের রাতে (২ জুলাই) তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী হাসিনা, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক (যিনি বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে) এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের (যিনি বর্তমানে মৃত) সঙ্গে বৈঠকের জন্য তাকে বঙ্গভবনে ডেকে পাঠানো হয়েছিল।

তিনি বলেন, বৈঠকে হাসিনা তাকে পরদিন (৩ জুলাই) সরকারের পক্ষে রায় দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান, কিন্তু তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার স্বার্থে তা প্রত্যাখ্যান করেন।

‘আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে প্রধানমন্ত্রী হয়ত সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চের অন্যান্য বিচারকদের সরকারের পক্ষে রায় দেওয়ার জন্য রাজি করিয়ে ফেলেছেন। এক পর্যায়ে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাদানুবাদ তীব্র আকার ধারণ করে এবং আমি তাকে বলি যে আমি এখনই পদত্যাগ করবো। এ কথা শুনে তিনি আমাকে পদত্যাগ না করার জন্য অনুরোধ করেন এবং বলেন, আমি পদত্যাগ করলে জনগণ তা খুবই খারাপভাবে নেবে। তিনি আমাকে যা ইচ্ছা তাই করতে বলেন।’

বিচারপতি সিনহা বলেন, ৩ জুলাই, ২০১৭ তারিখে আপিল বিভাগের সাতজন বিচারক সর্বসম্মতিক্রমে ১৬তম সংশোধনী বাতিলের রায় দেওয়ার পর, প্রধানমন্ত্রী হাসিনাসহ ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যরা তার তীব্র সমালোচনা করেন প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে।

‘তখন আমার মনে হয়েছিল, সরকার হয়ত আমাকে দেশে থাকতে দেবে না। আমি তাড়াহুড়ো করে অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কার্যক্রম (রায়ের পূর্ণাঙ্গ পাঠ প্রকাশসহ) সম্পন্ন করি। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান বিচারপতিদের এক সম্মেলনে যোগদান করতে আমি জাপান যাই। সম্মেলন কক্ষ থেকে বের হওয়ার পর, আমি ডিজিএফআই থেকে একটি ফোন কল পাই এবং আমাকে দেশে ফিরে না আসার কথা বলা হয়। একদিন পর, আমি সিঙ্গাপুর হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসি। ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর, আমি আবিষ্কার করি যে পাঁচ থেকে ছয় জন ডিজিএফআই সদস্য আমাকে ঘিরে রেখেছে। তারা আমার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতেও বাধা দেয়। একজন লম্বা লোক আমাকে বলেন যে তারা আমার সঙ্গে এক কাপ কফি খেতে চান এবং আমাকে তাদের পাঁচ মিনিট সময় দেওয়ার অনুরোধ করেন। আমি তাদের ভাষা ও প্রোটোকল মেনে চলার কথা বলি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে আমি 'চলে যান' বলি। তারা নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বাহানায় আমার সঙ্গে আমার গাড়িতে যেতে চান। আমি তাদের বলি যে আমার নিজস্ব গাড়ি এবং নিরাপত্তা আছে এবং আমার তাদের প্রয়োজন নেই, এই বলে আমি চলে আসি। আমি ভেবেছিলাম এটা আরেকটা খারাপ সংকেত।’

‘আমি আদালতে (সুপ্রিম কোর্ট) যাই। একদিন, আমি ঠিক আমার কাজ শেষ করেছি, এমন সময় ডিজিএফআই প্রধান আমার অফিসে আসেন। তিনি আমাকে বলেন যে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তাকে পাঠিয়েছেন এবং তিনি আমাকে পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করার জন্য বলেছেন। আমি চিৎকার করে বলি ‘আপনি কে এবং আপনি কী বলছেন?’ তিনি (ডিজিএফআই প্রধান) বলেন যে তারা কেবল প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশই বাস্তবায়ন করেন, আইনমন্ত্রী বা অ্যাটর্নি জেনারেলের নয়... আমি তাকে চলে যেতে বলি। তারপর আমি বাড়ি ফিরে গেলে আমাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়।’

‘সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আমাকে জানান যে, তাদের কিছু করার নেই। তিনি আমাকে কয়েকদিনের ছুটি নিতে বলেন। আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। আমার সচিব সাত দিনের ছুটির জন্য একটি আবেদনপত্র তৈরি করেন এবং আমি তাতে স্বাক্ষর করি। সন্ধ্যায় আমি বাড়ি ফিরি। আমি আমার বাসভবনের সব গেট বন্ধ পাই। বেসামরিক পোশাকে সামরিক কর্মীরা আমার বাসভবনের ভেতরে সবকিছু দখল করে নিয়েছে। আমার ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে।’

‘পরের দিন সকাল প্রায় ১০টার দিকে আমি আমার বাসভবনের অফিসে কাজ করছিলাম। মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা আমাকে ফোন করে আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। আমি তাকে আমার বাড়িতে আসতে বলি। তিনি (ওয়াহ্হাব) আমাকে তার বাসভবনে যেতে বলেন। তিনি বলেন অন্যান্য বিচারকরা তার বাড়িতে আছেন। তাৎক্ষণিকভাবে, আমি বুঝতে পারি যে এখানে একটি ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমি তাদেরকে আমার বাড়িতে আসতে বলি। তারপর তারা আসেন এবং আমাকে বলেন যে তারা আমার সঙ্গে আদালতে বসবেন না। আমি বুঝতে পারি যে আমার পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। সরকারের প্রভাবে তারা (বিচারকরা) এই অবৈধ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।’

এই পরিস্থিতির মধ্যে, ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর রাতে বিচারপতি সিনহা ঢাকা ত্যাগ করেন।

বিচারপতি সিনহার অনুপস্থিতিতে আপিল বিভাগের তৎকালীন সিনিয়র বিচারক বিচারপতি ওয়াহ্হাব প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন।

ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলার সময়, বিচারপতি সিনহা নোবেল জয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং বিচারপতি সৈয়দ রিফাত আহমেদকে নতুন প্রধান বিচারপতি হিসেবে দেখতে পেয়ে অভিনন্দন জানান।

সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসতে প্রস্তুত।

‘আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে আমি দেশে যাব। আমি একটি সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় আছি। আমি সংশ্লিষ্ট আদালতে আত্মসমর্পণ করব এবং প্রমাণ করব যে আমার বিরুদ্ধে যে মামলা দায়ের হয়েছে তা মিথ্যা।’

২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর বিদেশে থাকাকালীন প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন বিচারপতি সিনহা। তার বিরুদ্ধে তিনটি অর্থ পাচারের মামলা চলমান রয়েছে। একটি মামলায় তাকে ১১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং অন্য দুটি মামলা তদন্তাধীন আছে।

সাক্ষাৎকারটি ডেইলি স্টার থেকে অনূদিত

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.