ভারী বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের তাণ্ডব, লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি, বিপর্যস্ত জনজীবন

ভারী বৃষ্টিপাত এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যায় পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ব্যাপক এলাকা তলিয়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষ বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন অবস্থায় জরুরি উদ্ধারের অপেক্ষায় রয়েছেন।

ছবি - সংগৃহীত

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কেএম আলী রেজা ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী জেলায় দুই জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় এ পর্যন্ত ১০ জেলায় ৩৬ লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং প্রায় ছয় লক্ষ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। অবস্থা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

স্থানীয় ও সরকারি জরুরি ত্রাণকর্মীরা এই বন্যাকে ‘অভূতপূর্ব’ বলে অভিহিত করেছেন। গত কয়েক দশক ধরে এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়নি এমন এলাকাগুলো এই আকস্মিক জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলায় সম্পূর্ণরূপে অপ্রস্তুত ছিল।

এই বন্যার ভয়াবহতা এর তাৎক্ষণিক প্রভাবগুলোতে স্পষ্ট - স্টিলের রেললাইন বাঁকা হয়ে যাওয়া, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের সাথে ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যান চলাচল ব্যাহত, বিশাল ভূখণ্ড তলিয়ে যাওয়া, হাজার হাজার মৎস্য ও হাঁস-মুরগির খামার ধ্বংস এবং ৮২,০০০ এরও বেশি মানুষ সাময়িকভাবে বাস্তুহারা হয়ে পড়েছে।

ফেনীতে ভয়াবহতা, শহরেও ঢুকেছে পানি

ফেনীর পরশুরাম, ফুলগাজি ও ছাগলনাইয়া উপজেলায় প্রায় ৩৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে একতলা ভবনের উচ্চতায় পানি স্থির রয়েছে। শত শত মানুষ তাদের গবাদি পশু নিয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে ছাদের উপর আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন এবং এই অবিরাম বৃষ্টির মধ্যে খোলা আকাশের নীচে দিনাতিপাত করছেন।

জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুর রহমান জানিয়েছেন, ‘ফেনী শহরে পানি প্রবেশ করেছে।’ তিনি আরও নিশ্চিত করেছেন যে, ২০,০00 মানুষকে ইতিমধ্যে বন্যা নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা হয়েছে।

‘খারাপ খবর হলো বন্যার পানির উচ্চতা আরও বাড়ছে,’ তিনি বলেন।

বুধবার সন্ধ্যা থেকে ফেনীর তিনটি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার কারো সঙ্গেই যোগাযোগ করতে পারেননি আব্দুর রহমান।

ফেনীতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বন্যার পানি উপচে পড়ায় যানবাহন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।

লক্ষ্মীপুরে ধ্বংস হয়েছে হাজার হাজার পুকুর ও মৎস্য খামার

জেলায় মোট ১৭,৫০০ টি পুকুর ও মৎস্য খামার ধ্বংস হয়ে গেছে, যেখানে পাঁচ হাজার টন মাছ চাষ করা হচ্ছিল।

লক্ষ্মীপুরে বন্যার পানিতে ১,৪৮৬ হেক্টর জমির আমন বীজতলা, ২,৬১৮ হেক্টর জমির রোপা আমন, ২,৯৬৩ হেক্টর জমির রোপা আউশ ও ৪৪৩ হেক্টর জমির শাকসবজি নষ্ট হয়ে গেছে।

নোয়াখালীতে ২০ লাখ মানুষ বন্যার পানিতে

নোয়াখালী জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহিদ হাসান খান বলেন, তার জেলায় ২০ লাখ মানুষ বন্যার পানিতে ডুবে গেছে।

স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের দপ্তর গোমতী নদীর পানি আরও বাড়ার বিষয়ে সতর্ক করেছে।

হবিগঞ্জে খোয়াই নদীর পানি রেকর্ড ছাড়িয়েছে

বুধবার হবিগঞ্জে খোয়াই নদীর পানির উচ্চতা রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, ছয় জেলায় ১৪টি স্থানে সাতটি নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকাল ৯:০০ টায় খোয়াই নদীর পানি বাল্লা পয়েন্টে বিপদসীমার ২৭৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

মৌলভীবাজারে বাঁধ ভেঙে আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি

মৌলভীবাজার প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জেলার দুটি উপজেলায় দুটি স্থানে মনু নদীর পানি বন্যার্তদের রক্ষার জন্য নির্মিত প্রতিরক্ষা বাঁধ ভাঙিয়ে প্রবেশ করেছে, যার ফলে আড়াই লক্ষ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

বাঁধ ভাঙার ফলে মৌলভীবাজার-রাজনগর-ফেঞ্চুগঞ্জ ও মৌলভীবাজার-কুলাউড়া-বারলেখা সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রামে সর্বাধিক বৃষ্টিপাত, ভূমিধ্বসের আশঙ্কা

বাংলাদেশ আবহাওয়া বিভাগের তথ্য মতে জানা গেছে, গত ১৭ আগস্ট থেকে চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, কক্সবাজার, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি জেলায় ৩০০ মিলিমিটার থেকে ৫০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এই সব জেলা বন্যায় ডুবে গেছে।

এর মধ্যে চট্টগ্রামে ও নোয়াখালীতে সর্বাধিক ৫৩২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধ্বসের বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্য প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে

তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের বরাত দিয়ে সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসস জানিয়েছে, প্রায় ১৫ শতাংশ মোবাইল টাওয়ার বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, প্রায় ছয় লক্ষ মানুষ বিদ্যুৎ সংযোগ ছাড়াই কাল রাত যাপন করেছেন, বিশেষ করে ফেনী, কুমিল্লা ও চাঁদপুর জেলায়।

রাতের অন্ধকারে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ভয়াবহতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে, কারণ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস এবং স্থানীয়দের ত্রাণ দলগুলোর কাছে পৌঁছাতে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

আরও বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস

আবহাওয়া বিভাগ পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার জন্য ভারী বৃষ্টিপাতের সতর্কতা জারি করেছে। ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের জন্য এই ভারী বৃষ্টিপাতের সতর্কতা জারি করা হয়েছে।