মোদির রাশিয়া সফর: ভারতের ভারসাম্য রক্ষার কৌশল!
- Details
- by আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাশিয়া সফর ভারতের কূটনীতিতে নিজস্ব স্বার্থের গুরুত্ব স্পষ্ট করে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, ভারত ভূ-রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে স্বাধীনভাবে নিজস্ব নীতি গ্রহণে অটল।
নরেন্দ্র মোদি ও ভ্লাদিমির পুতিন
মস্কোতে মোদি ও পুতিনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বের প্রকাশ স্পষ্ট। রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আন্তরিক আলিঙ্গনে স্বাগত জানিয়েছেন হাস্যোজ্জ্বল মোদিকে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন, দুই নেতার সম্পর্ক দুই দশকেরও বেশি পুরনো।
মস্কো ও দিল্লির এই ঘনিষ্ঠতা তীব্র বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ তিনি বলেন, ‘বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের নেতা যখন বিশ্বের সবচেয়ে রক্তক্ষুধ অপরাধীর সঙ্গে আলিঙ্গন করছেন, এটা শান্তিকামী প্রচেষ্টার জন্য ঘোর হতাশা ও ক্ষতিকর।’ তিনি কিয়েভের একটি শিশু হাসপাতালে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, এর জন্য মস্কো দায়ী, যদিও রাশিয়া এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
গত এক দশকে মোদি ছয় বার রাশিয়ায় গিয়েছেন এবং কমপক্ষে ১৭ বার পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
গত মাসে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর এটি ছিল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম দ্বিপাক্ষিক বিদেশ সফর, যা এটিকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
ভারতের নতুন কৌশলগত মিত্র যুক্তরাষ্ট্র মোদিকে তার মস্কো সফরে ইউক্রেনের ভৌগোলিক অখণ্ডতার বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। এর মাধ্যমে পশ্চিমা শক্তিগুলো ইঙ্গিত দিয়েছে যে রাশিয়ার ওপর তারা যে চাপ প্রয়োগ করছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভারত যথেষ্ট কিছু করেনি।
ভারত এখনও পর্যন্ত ইউক্রেন যুদ্ধের নিন্দা জানাতে পশ্চিমাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে এবং আন্তর্জাতিক আইন, সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কথা বলেছে।
মস্কোতে মোদি এই কথা আবার বলেন এবং বলেন যে ‘যুদ্ধ কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে না’ এবং সমাধানের পথ হলো আলোচনা ও কূটনীতি।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ভারতের সিনিয়র বিশ্লেষক প্রবীণ দোঁথির কাছে মোদির এই ভারসাম্য রক্ষার কৌশল কোনো অবাক করার মতো বিষয় নয়।
তিনি আনাদোলুকে বলেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। এটি দীর্ঘদিন ধরে ভারতের বিদেশ ও কৌশলগত নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।’
‘১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত হওয়ার পর এটি আরও সুদৃঢ় হয়, কারণ তখন ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান ইতিমধ্যেই তাদের কাছাকাছি চলে আসে। এই জোটকে প্রতিহত করার জন্য নয়াদিল্লি মস্কোর সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যখন পশ্চিমা বিশ্ব অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, তখনও মস্কো পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভারতকে সাহায্য করেছিল।’
‘ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নকারীদের মধ্যে রাশিয়ার প্রতি এখনও একটি শক্তিশালী সম্পর্ক বিদ্যমান এবং পশ্চিমাদের প্রতি কিছুটা অবিশ্বাস রয়ে গেছে,’ দোঁথি বলেন।
‘যদিও ভারত ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা মিত্রদের নিকটে স্থানান্তরিত হচ্ছে, তবুও এই বিষয়টি হয়তো ভারত-রাশিয়া সম্পর্ককে ছাপিয়ে যাবে না।’
প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য এবং তার বাইরেও
রাশিয়া এখনও ভারতের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী। যদিও স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-২০১৭ সালে ভারতীয় প্রতিরক্ষা আমদানির যেখানে ৬২ শতাংশ ছিল, ২০১৯-২০২৩ সালে এই হার কমে ৩৬ শতাংশ হয়েছে।
নয়াদিল্লি রাশিয়া থেকে বাকি দুটি এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। এই অস্ত্র ক্রয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ছাড় দিয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব ও ভারতের মধ্যে আরেকটি মতবিরোধের সূত্র হলো পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পর রাশিয়ার কাছ থেকে বিপুল ছাড়ে তেল ক্রয়।
যুদ্ধের আগে ভারতের মোট তেল আমদানির ২ শতাংশ ছিল রাশিয়া থেকে। বর্তমানে এই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশ। ফলে রাশিয়ার তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা এখন ভারত।
মোদির সফর শেষে এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৬৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বৃদ্ধি করে ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে দুই দেশ সম্মত হয়েছে।
এই লক্ষ্যে ট্যারিফ-বহির্ভূত বাধা দূরীকরণ, ‘জাতীয় মুদ্রা ব্যবহার করে দ্বিপাক্ষিক লেনদেন ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠা, শুল্ক পদ্ধতি সহজীকরণ এবং চেন্নাই-ভ্লাদিভোস্টক স মুদ্রপথ, উত্তর সমুদ্রপথ এবং ইরান হয়ে আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ পরিবহন করিডোর সহ নতুন যোগাযোগ রুট ব্যবহারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
পারমাণবিক শক্তিসহ অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বিনিয়োগ প্রচারকে ‘অগ্রাধিকারমূলক ক্ষেত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বিশ্লেষক প্রবীণ দোঁথির মতে , এই সহযোগিতা প্রমাণ করে যে ‘চীনের সঙ্গে একলা রেখে দেওয়ার চেয়ে রাশিয়াকে যোগাযোগের জন্য আরও বেশি সুযোগ ও পথ দিতে চায় ভারত।’
তিনি মনে করেন, পশ্চিমা বিশ্বও ‘ভারতকে রাশিয়ার বন্ধু হিসেবে পাওয়ার সুবিধা বুঝতে পেরেছে।’ ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন ভারতের মাধ্যম থেকে রাশিয়ার তেল কিনেছে তখন এটি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
একটি বহুমুখী বিশ্বে একটি শক্তি
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ওয়াজাহাত কাজী মনে করেন, ক্রমবর্ধমান এই বহুমুখী বিশ্বে ভারত সকল সম্ভাবনা খোলা রাখতে চায়।
তিনি বলেন, ‘পশ্চিমা বিশ্ব তাদের ঘাঁটিতে ভারতকে টানার চেষ্টা করলেও ভারত তার কৌশলগত স্বাধীনতা বিদেশ নীতির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে।’
‘মোদির সফরের সময় তাৎপর্যপূর্ণ। এমন এক সময়ে যখন পশ্চিমা বিশ্ব পুতিনকে তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে, তখন মোদির এই সফর রাশিয়ার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপনের মতো মনে হচ্ছে।’
মোদির এই সফরের আরও কিছু মাত্রা রয়েছে, যেমন চীন এবং দেশীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুবোজিত বাগচী বলেন, রাশিয়া এখনও ভারতের একজন ‘সর্বক্ষণের বন্ধু’। আঞ্চলিক বিষয়গুলোতে তারা রাশিয়ার কাছে মধ্যস্থতার জন্য ফিরে আসতে পারে।
ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত সংঘাতের সময় রাশিয়া একজন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বাগচী পুতিনের মতো ‘একজন শক্তিশালী নেতা’ হিসেবে মোদির obraz বজায় রাখার জন্য এই সফরকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।
তার মতে, তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর মোদিকে দেশীয়ভাবে তার ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য এই সফর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তিনি বলেন, ‘রাশিয়া সফর সেই লক্ষ্যেই একটি পদক্ষেপ।’
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ‘স্বার্থ-ভিত্তিক বিদেশ নীতি’ অনুসরণ করাকে তার প্রধান কৃতিত্ব বলে মনে করেন মোদি।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশেষজ্ঞ দোঁথি জোর দিয়ে বলেন যে "চীনের একটি গণতান্ত্রিক প্রতিরোধক হিসেবে ভারত একটি ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।’
‘বর্তমানে তার বিদেশ নীতির মূল লক্ষ্য হলো স্বার্থ রক্ষা করা এবং তারা মনে করে যে ভূ-রাজনীতি ক্রমশ লেনদেনমূলক হয়ে উঠছে,’ তিনি বলেন।
‘ভারত একটি বহুমুখী বিশ্বে একটি শক্তি হতে চায় এবং এজন্য তারা পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাবে।’
লিখেছেন হিলাল মির, আনাদোলু এজেন্সি থেকে নেওয়া।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.