আপনি পড়ছেন

সর্বত্র যুদ্ধের রক্তচক্ষু। আকাশে ঘুরছে মৃত্যুর ড্রোন, প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বোমার ভয়াল শব্দ। এই যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার এক কোণে গড়ে উঠেছে আশার এক অভয়ারণ্য— ‘গাজা গ্রেট মাইন্ডস’। রঙিন পোস্টার, হরেক রকম খেলনা আর আকর্ষণীয় ছবি দিয়ে সাজানো এই তাঁবু স্কুলটি যেন যুদ্ধাহত শিশুদের জন্য স্বপ্নের এক টুকরো স্থান।

english teacher ahmed abo rizikইংরেজি শিক্ষক ও অভিভাবক আহমেদ আবু রিজিক

এই অভিনব স্কুল প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছেন ২৭ বছর বয়সী তরুণ ইংরেজি শিক্ষক আহমেদ আবু রিজিক। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলি বোমা আর বিমান হামলার সামনে এই তাঁবু স্কুল হয়ত বেশিদিন টিকে থাকতে পারবে না। তবুও, এখন এটিই আমাদের শিশুদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়।’

যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে শিশুদের মনকে সুরক্ষিত রাখা এবং ইসরায়েলি হামলার মানসিক ক্ষত কিছুটা হলেও মোছার জন্যই আহমেদের এই অসাধ্য সাধন। ব্যক্তিগত ক্ষতি এবং শিক্ষা ব্যাহত হওয়ার কারণে যেসব শিশুর মন আজ ভীষণ ভাবে বিপর্যস্ত, তাদেরকে আবার নতুন করে বাঁচতে শিখতে হবে, জীবনের প্রতি আগ্রহ ফিরে পেতে হবে— আর সেটাই চান আহমেদ।

‘শিক্ষাই হলো সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ,’ আহমেদের কণ্ঠে অন্যরকম এক দৃঢ়তা।

যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার চিত্র যেন এক ভয়াবহ স্বপ্ন। রাস্তার ধারে অস্থায়ী তাঁবুতে দিনাতিপাত করা শিশুদের দিকে তাকালে যে কারো হৃদয় ছিঁড়ে যাওয়ার জোগাড়। এক কেজি চাল বা চিনির জন্য শিশুদের ছুটোছুটি দেখে আহমেদের মনেও জেগে উঠে গভীর অপরাধবোধ। একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি বিশ্বাস করেন, এই শিশুদের আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য তার কিছু একটা করতেই হবে।

আহমেদ বলেন, ‘রাস্তায় থাকা, স্কুল বা তাঁবুতে আশ্রয় নেওয়া খালি পায়ের এসব শিশুদের দেখে আমার খুব কষ্ট হতো। তখনই আমার মাথায় 'গাজা গ্রেট মাইন্ডস' এর চিন্তাটা আসে। এই যুদ্ধে আমার পাঁচ জন ছাত্র হারিয়েছি। তাদের স্মৃতি ধরে রাখতে এবং বাকি শিশুদের জীবনে আবার আলো ফিরিয়ে আনার জন্য আমি এই কাজ শুরু করি।’

এই স্কুলের শুরুটা হয়েছিল গত ১ মে। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই, ১৪ মে গাজা শহরে প্যারাসুট ও কিছু স্থানীয় সম্পদের মাধ্যমে প্রথম তাঁবু স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। আহমেদ তার নিজের অর্থে স্কুলের জন্য চেয়ার কিনেছেন। যুদ্ধাহত স্কুল এবং আশ্রয়কেন্দ্রের মানসিক আঘাত থেকে দূরে থেকে শিশুরা যেন নিরাপদ পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে, পাশাপাশি যেন তারা মানসিক সহায়তা পায়— সেটাই এই স্কুলের একমাত্র লক্ষ্য।

‘গাজা গ্রেট মাইন্ডস’ শুধু আহমেদের স্বপ্নের স্কুল নয়, এটি আরও অনেক শিক্ষাবিদ এবং স্বেচ্ছাসেবকের ভালোবাসার স্পর্শ। একজন ইউক্রেনীয় মা ও তার মেয়ে এই স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। তাদের মতো আরও অনেক স্বেচ্ছাসেবক এবং শিক্ষক এই স্কুলের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।

‘যুদ্ধের আগে আমি এই এলাকায় অনেক বছর ধরে ইংরেজি শিক্ষকতা করেছি। ফলে বিভিন্ন শিক্ষা কেন্দ্রের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল এবং ‘টিচার্স উইদাউট বর্ডার্স’ এর মতো সংগঠনের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল। তারাই মূলত আমাদের এই উদ্যোগে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছেন,’ বলেন আহমেদ।

'গাজা গ্রেট মাইন্ডস'-এর প্রথম দিন ছিল উত্তেজনা ও ভয়ের মিশ্রণ। আহমেদ জানান, যেকোনো শিশুকেই তিনি খুব সহজেই হাসিখুশি করে তুলতে পারেন। কিন্তু এই যুদ্ধ যেন শিশুদের মন থেকে সকল রঙ কেড়ে নিয়েছে। তাদের মুখে এখন আর সহজে হাসি ফোটে না। একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে আহমেদ জানতে পারেন, এই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে শিশুদের অনেক সময় লাগবে।

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের পরিবর্তন হচ্ছে। শিক্ষকদের প্রতি শিশুদের আস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্কুলে আসা শিশুদের মুখে ফিরে আসছে হারিয়ে যাওয়া হাসি।

‘আপনারা যদি এখন আমাদের স্কুলে আসেন তাহলে শিশুদের আনন্দ দেখে অবাক হবেন। কারণ এখন তারা আমাদের বিশ্বাস করে এবং আমাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে,” বলেন আহমেদ। প্রতি সপ্তাহে স্কুলে গান ও নৃত্যের মাধ্যমে শিশুদের বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয় যা তাদের কাছে অনেক আনন্দের।

ইংরেজি, আরবি ও গণিতের পাশাপাশি এখানে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে শিশুদের নিয়মিত কাউন্সেলিং করা হয়। শিশুরা সবচেয়ে বেশি আনন্দ পায় গান এবং নৃত্যের মাধ্যমে,’ বলেন আহমেদ। মানসিক আঘাত কমাতে এবং শিশুদের মন থেকে ভয় দূর করতে এসব কর্মকাণ্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলেও জানান তিনি।

এই স্কুলে শিক্ষকরা শুধু শিক্ষকের ভূমিকাই পালন করেন না, বরং একজন অভিভাবক ও থেরাপিস্টের ভূমিকাও তারা সমান তালে পালন করে যাচ্ছেন।

আহমেদ বলেন, অনেক শিশু তাদের বাবা-মাকে হারিয়েছে। তারা তাদের শিক্ষকদের 'মা' অথবা 'বাবা' বলে ডাকে। যুদ্ধ যে শূন্যতা তৈরি করেছে শিক্ষকরা চেষ্টা করছেন সেটা পূরণ করার। আহমেদ প্রায়ই শিশুদের ব্যাগে চুপি চুপি চকলেট রেখে দেন এবং বলেন এটা তাদের বাবার পক্ষ থেকে উপহার।

‘একটি ছেলে যুদ্ধে তার বাবাকে হারিয়েছে। যখনই সে তার বাবার কথা মনে করে তখনই কাঁদতে শুরু করে। আরেক শিশু লোয়া বলে, ইসরায়েলি বাহিনী তাদের স্কুলে হামলা চালিয়ে তার বাবাকে ধরে নিয়ে যায় এবং পরে হত্যা করে। সৈন্যরা তাকে বিস্কুট দিয়ে বলে খেতে। কিন্তু সে কাঁদতে কাঁদতে বলে যে তার বিস্কুট চাই না, তার বাবাকে ফিরিয়ে দিতে।’

বর্তমান এই যুদ্ধকে অতীতের যেকোনো যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ বলে মনে করেন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এটা শুধু যুদ্ধ নয়; এটা গণহত্যা।’

আহমেদ বলেন, ড্রোন এবং বোমার হামলার চেয়েও যে বিষয়টি আহমেদ ও তার সহকর্মীদের বেশি কষ্ট দেয় তা হলো অনেক শিশুর নিরুপায় থাকা। নাস্তা না খেয়েই অনেকে স্কুলে আসে। ক্ষুধার্ত থাকার কারণে তারা ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারে না।’

প্রথমদিকে তিনি ছাত্রদের জন্য প্রতিদিন তিনটি করে স্যান্ডউইচের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন। কিন্তু অর্থের অভাবের কারণে এখন তাও বন্ধ রাখতে হচ্ছে।

‘গাজা গ্রেট মাইন্ডস’ বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অনেক দেশ ও সংগঠন এই স্কুলকে সাহায্য সহযোগিতা করছে। তবে এখানকার চাহিদা অনেক বেশি। আহমেদ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে শুধু পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন না করে গাজার জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে।’

আহমেদ ও তার ছাত্ররা সব সময় বিপদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে। সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে একটি ড্রোনের আওয়াজ শোনা যায়। কিছুক্ষণ পরই একটি ভয়াবহ বিস্ফোরণে কাঁপে সমস্ত এলাকা। ‘এই হামলায় আমারও মৃত্যু হতে পারতো,’ ভয়ে ভরা কন্ঠে বলেন আহমেদ। একটি এফ-১৬ বিমান নিকটবর্তী ঘরগুলোতে এই হামলা চালায় বলে জানা গেছে।

‘আমি যদি মারা যাই, তোমরা বেঁচে থাকো আমার গল্প মানুষকে বলার জন্য,’ আবেগাপ্লুত কন্ঠে বলেন আহমেদ। ডিসেম্বর মাসে এক ইসরায়েলি বিমান হামলায় আহমেদের শিক্ষক ও বিখ্যাত লেখব ড. রিফাত আলারির মৃত্যু হয়। আহমেদ তার মৃত্যুর আগে লেখা একটি কবিতার কিছু লাইন মনে করিয়ে দেন।

বিমান হামলার পর সারা আকাশ ছয়াপথ হয়ে ওঠে। শোনা যায় শুধু এ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের আওয়াজ। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছে গাজার মানুষ। তবুও হাল ছাড়তে নারাজ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘যাই হোক না কেন, আমরা এগিয়ে যাব। তাঁবু ধ্বংস হলে আবার নতুন তাঁবু তৈরি করব। আমার যদি কিছু হয়ে যায়, অন্য কেউ আমার এই কাজ চালিয়ে যাবে। কারণ একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্রকে আবার গড়ে তুলতে হলে সবার আগে মানুষের মন গড়ে তুলতে হবে।’

মিডলইস্ট মনিটর থেকে অনুদিত, লেখক: আঞ্জুমান রহমান। অনুবাদ করেছেন মো. জামাল উদ্দিন।

Get the latest world news from our trusted sources. Our coverage spans across continents and covers politics, business, science, technology, health, and entertainment. Stay informed with breaking news, insightful analysis, and in-depth reporting on the issues that shape our world.

360-degree view of the world's latest news with our comprehensive coverage. From local stories to global events, we bring you the news you need to stay informed and engaged in today's fast-paced world.

Never miss a beat with our up-to-the-minute coverage of the world's latest news. Our team of expert journalists and analysts provides in-depth reporting and insightful commentary on the issues that matter most.