আপনি পড়ছেন

অফিসে এসে গোটা বিশেক পত্রিকা উল্টেপাল্টে দেখলাম। দৈনিক পত্রিকায় কাজের সুবাদে প্রায় প্রতিদিনই ১০/১৫টি জাতীয় পত্রিকা উল্টেপাল্টে দেখতে হয়। সবগুলো পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় করে ছাপা হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি, মাননীয় প্রধনমন্ত্রীর ছবি ও বক্তব্যের খবর। বিষয় আওয়ামী লীগের ৭৫ বছর পূর্তি বা প্লাটিনাম জুবিলি উপলক্ষে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গতকাল অনুষ্ঠিত আলোচনা সভা। সভায় আওয়ামী লীগকে গণমানুষ ও জনগণের অধিকার আদায়ের সংগঠন বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘জনগণের আর্থসামাজিক উন্নতি করার সংগঠন হচ্ছে আওয়ামী লীগ। বারবার আঘাত করেও এ সংগঠনের কেউ ক্ষতি করতে পারেনি। ফিনিক্স পাখির মতো...যেমন পুড়িয়ে ফেলার পরেও ভস্ম থেকে জেগে ওঠে, আওয়ামী লীগও সেইভাবে জেগে উঠেছে।’

sheikh hasina and fakhrul islam alamgir tearsছবি - সংগৃহীত

শুধু একটি পত্রিকায় দেখলাম একটু ব্যতিক্রম চোখে পড়লো। পত্রিকাটির প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে কান্নারত মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ছবি। 'খালেদার জন্য কাঁদলেন ফখরুল' শিরোনামের খবরটি হলো বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হৃদযন্ত্রে পেসমেকার বসানো নিয়ে। রাজধানীর একটি হাসপাতালে গতকাল বিএনপি চেয়ারপারসনের হৃদযন্ত্রে পেসমেকার বসানো হয়েছে। গতকালই দলটির নয়াপল্টনস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তার আশু রোগমুক্তি কামনা করে আয়োজিত দোয়া মাহফিলে কান্নায় ভেঙে পড়েন মির্জা ফখরুল। খবর অনুযায়ী, এ সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক। জীবনমৃত্যু এতই সন্ধিক্ষণে, শুধু প্রাণ খুলে দোয়া করুন সবাই। যাতে আমরা তার নেতৃত্বে আবার জেগে উঠতে পারি।’

দুই.
দৈনিক পত্রিকায় আমরা দেখি আগের দিনের খবর ও বিশ্লেষণ। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া একদম আপডেট। প্রতি মুহূর্তে এতে ঘোরাফেরা করে নতুন নতুন তথ্য। মন্তব্য, মত-দ্বিমত। গত দুদিনের সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে যারা চোখ রেখেছেন, তারা সবাই এটা খেয়াল করেছেন যে, কয়েকটি মূল আলোচনার মধ্যে অগ্রভাগে রয়েছে 'বাংলাদেশ-ভারত রেল করিডরের' বিষয়টি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদ্য ভারত সফরের পর থেকেই সামাজিকমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। খবরে প্রকাশ, এবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে, দু'দেশের মধ্যে '১০টি সমঝোতা স্মারক ও নথি সই' হয়েছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের ট্রেন পরিচালনা নিয়ে নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউজে গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে রেল যোগাযোগ নিয়ে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়। এমওইউ স্বাক্ষর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা বাংলাদেশের রেলপথ ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন।

সোশ্যাল মিডিয়ায় নানান চিত্র, নকশা, কার্টুনের উপস্থিতি দেখা গেছে। এর বেশিরভাগই দেখা গেছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। অনেকেই বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের রেল চালনার খবরে তাদের ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ বাংলাদেশের ভূখন্ডের ওপর দিয়ে ভারতের রেল চালনার খবরটিকে আগামীতে তা দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে কিনা এমন প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসছেন। কেউবা এক লাইনের একটি বাক্য পোস্ট করেছেন। তাদের জিজ্ঞাসু প্রশ্ন- 'ভারতকে ট্রেন লাইন দিয়ে বাংলাদেশের কী লাভ?'

তিন.
ভারত বাংলাদেশের বড় প্রতিবেশী। রাষ্ট্র হিসেবেও তারা অনেক বড়। দেশটির ভুখণ্ড, জনসংখ্যা, অর্থনীতির আকার বিরাট। সে তুলনায় বাংলাদেশ ছোট দেশ। দেশ যত ছোটই হোক, আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছি যুদ্ধ করে। সে যুদ্ধে ভারত আমাদের মিত্র ছিল, তা ইতিহাসেরই অংশ। স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের একটি নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ নিয়েও নিশ্চয়ই ভারতের আলাদা ও নির্দিষ্ট পররাষ্ট্রনীতি রয়েছে। দেশে বড়-ছোট যাই হোক, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে লাভ-লোকসানের প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই সামনে আসবেই। তাই বাংলাদেশ ট্রান্স-এশিয়ান রেলপথে যুক্ত হোক কিংবা ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিক— এ বিষয়টিকে নিয়ে নানাভাবে আলোচনার জন্য আপাতত টেবিলে রাখছেন আমাদের বিশেষজ্ঞরাও। এর বিনিময়ে বাংলাদেশ যেন মুনাফার ন্যায্য ভাগ পায়, সেদিকে নজর দেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করছেন তারা। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের রেল চালনাসংক্রান্ত দৈনিক বণিক বার্তার একটি খবরে দেওয়া মন্তব্যে বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেছেন, ‘‌বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারত ট্রেন পরিচালনা করলে তাদের দূরত্ব অনেকটাই কমে যাবে। তাদের পণ্য সরবরাহ সক্ষমতা বাড়বে। পণ্য পরিবহনের ব্যয় কমবে। ভারতের এ লাভ-ক্ষতির হিসাবটাও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে।’

চার.
এই যে সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা চায়ের দোকানের রাজনৈতিক সভা, সবখানেই আলোচনার বিষয় 'রেলপথ'। কিন্তু কোথাও কি পরিষ্কারভাবে কিছু বোঝা যাচ্ছে? জনমানসের বক্তব্য কি অনুধাবন করতে পারছে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো? সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সুযোগ কম। কারণ, দেশের স্বার্থ-সংশিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার সবচেয়ে ভালো জায়গা হচ্ছে জাতীয় সংসদ। কিন্তু সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক কারণে ২০১৪ সাল থেকেই সংসদের বাইরে রয়েছে দেশের বড় দু্ই রাজনৈতিক দলের একটি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি। এবং তাদের সঙ্গে নির্বাচনের বাইরে রয়েছে তাদের মিত্র দলগুলোও।

এটা সবাই জাননে যে, দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের সখ্যতা নিরবচ্ছিন্ন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। ভারত যেহেতু স্বাধীনতার মিত্রশক্তি ছিল, ফলে ১৯৭১ থেকেই ভারতের সঙ্গে নানান মাত্রার সম্পর্ক রক্ষা করে চলে দলটি। অপরদিকে বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটির জন্ম হয়েছে স্বাধীনতার অনেক পরে। এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, বিএনপির জন্মের মধ্যে ভারতবিরোধী উপাদান প্রবল ছিল। সামরিক শাসক হিসেবে জিয়াউর রহমানের উত্থান ও বিএনপি নামক রাজনৈতিক দল গঠনের ইতিহাসের পৃষ্ঠা উল্টালেই নতুন প্রজন্মের পাঠকের সামনেও বিষয়টি দৃশ্যমান হবে। পরবর্তী সময়ে বেগম খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানের বক্তব্যেও ভারত প্রশ্নে দলটির ক্রিটিক্যাল অবস্থানের প্রকাশ দেখা যায়।

পাঁচ.
টানা চার মেয়াদে দেশ শাসন করছে আওয়ামী লীগ। বলা যায় টানা তিন মেয়াদ ধরেই জাতীয় সংদের বাইরে বিএনপি ও তার মিত্ররা। তাহলে সংবাদমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা চায়ের দোকানের আলাপে 'বাংলাদেশ-ভারত রেলপথ করিডরের' লাভ-লোকসান বা জনস্বার্থের বিষয়টি নিয়ে আমাদের জাতীয় সংসদে কি আলাপ উঠবে? পুরো সংসদের প্রায় সব আসনই আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্রদের। অথবা আওয়ামী অনুসারী স্বতন্ত্রদের দখলে।

সংসদে যেহেতু বিএনপি নেই, তাহলে তারা এই 'রেলপথ' ইস্যুটি নিয়ে কোথায় বা কোন মাত্রায় কথা বলবে? জনগণের বড় একটি অংশ বিএনপির রাজনীতির অনুসারী। তারা ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন নীতি ও সিদ্ধান্তের সমালোচনা করতে চায়। কিন্ত 'সীমিত' রাজনৈতিক পরিসরে সে আলোচনা রাজনীতির মাঠে গড়াচ্ছে না। জনগনকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি আওয়ামী লীগের নতুন চেহারার রাজনীতির সামনে দাঁড়াতে পারছে না। এই হলো বাস্তবতা।

awami league 75 yearsআওয়ামী লীগের ৭৬ বছরে পদাপর্ণের মুহূর্তে পতাকা উড়াচ্ছেন দলটির সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

তাহলে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জেগে উঠা নিয়ে দলটির ৭৬ বছরে পদাপর্ণের মুহূর্তে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা আমরা উপরে যে উদ্ধৃত করেছি, তা আবার মিলেয়ে নিই তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ ফিনিক্স পাখির মতো। পুড়িয়ে ফেলার পরেও ভস্ম থেকে জেগে ওঠে। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগও সেইভাবে জেগে উঠেছে।

আওয়ামী লীগের এই জাগ্রত অবস্থায় রয়েছে দলটির প্রধান শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্ব। অপরদিকে, বিএনপি দলটি প্রায় নেতৃত্বশূন্য। চেয়ারপারসন দণ্ডপ্রাপ্ত। নিজের বাড়ীই তার কারাগার। তাও সরকারের বদান্যতায়। দলটির অপর বা মূল কান্ডারীও দীর্ঘদিনের প্রবাসী। তার ওপরেও রয়েছে অসংখ্য মামলা ও দণ্ডের ভার। ফলে, দৃশ্যত দলটির গুরুদায়িত্ব দীর্ঘদিন ধরেই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ওপর।

তিনিও বয়স ও রাজনৈতিক ভার, চাপ ও তাপে কাবু। সরকারবিরোধী রাজনীতি করবার শারীরিক সক্ষমতার প্রশ্নও কেউ কেউ তোলেন। তিনি যে বেগম খালেদা জিয়ার হৃদযন্ত্রে পেসমেকার বসানোর দিনে মিলাদ মাহফিলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থার প্রতি আশাবাদ রেখে বললেন, 'আপনারা শুধু প্রাণ খুলে দোয়া করুন সবাই। যাতে আমরা তার নেতৃত্বে আবার জেগে উঠতে পারি।’

fakhrul islam alamgir tearsবিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার জন্যে দোয়া চাইতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

আমরা মির্জা ফখরুলের এই প্রার্থনার প্রতি সমব্যাথী হয়েই একটি একটি কথা বলতে পারি, আজকের নতুন চেহারায় 'জেগে উঠা' আওয়ামী রাজনীতির বিরুদ্ধে কি সহসাই ফল দেখাতে পারবে মির্জা ফখরুলদের জেগে উঠার আশাবাদ? সময় ও প্রস্তুতি কতটা সাপেক্ষে তাদের? সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে আমাদের। ততদিন, পত্র-পত্রিকার লেখাজোকা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, চায়ের দোকানের পার্লামেন্টে এই 'রেলপথ' ইস্যুটা নিয়ে কথা হোক না। অসুবিধা কী?

মোজাব্বীর হাসান, সাংবাদিক। ক্রিয়েটিভ লিড, বণিক বার্তা।
২৪ জুন, ২০২৪ খ্রি.

mozabbir hasanমোজাব্বীর হাসান

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.