একাত্তরে পাকিস্তানি গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই
- Details
- by মো. মনিরুজ্জামান
মানব সভ্যতার ইতিহাসে একাত্তরে অন্যতম ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে পাকিস্তান। বাঙালী জাতিকেই খতম করতে চেয়েছিল তারা। ৩০ লাখ বাঙালি খুন হন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত আক্রমণে ৩ লাখেরও বেশি মা-বোনের সম্ভ্রম লুন্ঠিত হয়।
২৫ মার্চ, ১৯৭১ ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে শুরু হয় খান সেনাদের মানবাধিকার লুণ্ঠনের প্রতিযোগিতা। গণহত্যা চলে ঢাকাসহ গোটা দেশে। ২০১৭ সালের ১১ মার্চ তাই জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই থেকে প্রতি বছর বাংলাদেশ দিনটি গণহত্যা দিবস হিসাবেই পালন করছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক দুনিয়া আজও দিনটিকে স্বীকৃতি দেয়নি। মানব সভ্যতার ইতিহাসে তাদের ভয়ঙ্করতম হত্যাকাণ্ডের জন্য ক্ষমাও চায়নি পাকিস্তান।
স্বাধীনতার অনেক বছর পার হলেও গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আজও অধরা। একাত্তরে পাকিস্তানকে মদদ জুগিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। চীন অবশ্য আজও নীরব। তবে যুক্তরাষ্ট্রে দাবি উঠছে, গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে হবে। একই দাবি উঠছে বিভিন্ন দেশ থেকে। কিন্তু জাতিসংঘ ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রাঙা বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানি গণহত্যার কোনো স্বীকৃতি আজও দেয়নি। অথচ জাতিসংঘ টার্কদের হাতে ১৯১৫ সালে ১৫ লাখ আর্মেনীয়র গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় ৮ লাখ তুতসি জাতিগোষ্ঠির গণহত্যা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাজিদের হাতে ৬০ লাখ ইহুদির গণহত্যারও স্বীকৃতি মিলেছে। ১৯৯২ সালে বসনিয়া ও ১৯৭৫ সালে কম্বোডিয়ার গণহত্যাকেও স্বীকৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক দুনিয়া।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণাতেও উঠে এসেছে, একাত্তরে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতেই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট হাতে নিয়েছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে ডেকে নিয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করার। মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার ‘এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি’ নামক আত্মজীবনীতেও উঠে এসেছে পাকিস্তানিদের সেই পরিকল্পনার কথা। মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সেই রাতে ৭ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেপ্তার করা হয় আরও ৩ হাজার লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু হয়েছিল। এরপর সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলে মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করে বাড়িঘর। লুঠপাট চলে অবাধে। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠে শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি।’
পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল তাতে বলা হয় , ‘১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত ১ লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’ এ পরিকল্পনার মূলে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজী। মার্চের শুরুতেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সকল পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে যান। তিনি অবশ্য হত্যাকাণ্ড শুরুর আগেই ঢাকা থেকে ইসলামবাদে ফিরে যান। যাওয়ার আগে দিয়ে যান অসামরিক মানুষদের ওপর সামরিক অভিযানের নির্দেশ। বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল থেকেই প্রমাণিত পাকিস্তানি বর্বরতার ইতিহাস। পুরো অভিযানটাই হয় পাকিস্তান সরকার ও তাদের সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে। এমনকি, মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজাসহ বহু পাকিস্তানির লেখা আত্মজীবনী এবং বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনেও উঠে আসে সেই নৃশংসতা ও পরিকল্পনার কথা।
২৫ মার্চ রাতে সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাঙ্ক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলতে থাকে ঢাকা মহানগরী। মধ্যরাতে পিলখানা, রাজারবাগ, নীলক্ষেত আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনা। পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। রোকেয়া হলেই ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানিরা ভেবেছিল, বাঙালি জাতিকেই ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেবে। কিন্তু তারা ভুল ভেবেছিল। ২৬ মার্চই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তার আদর্শকে সামনে রেখে ৯ মাস সশস্ত্র লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করেন মহান মুক্তিযোদ্ধারা। ভারত প্রথম থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে ছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গোটা বিশ্ববাসীর সামনে পাকিস্তানি গণহত্যার বিবরণ তুলে ধরেন। আমেরিকা ও চীন অবশ্য মুক্তিযোদ্ধারের বিরুদ্ধে অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানকে সাহায্য করে।
স্বাধীনতা লাভের পরও ষড়যন্ত্র কমেনি। জাতির পিতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তার কন্যা শেখ হাসিনাকেও বহুবার হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি আজও পাকিস্তানকে মদদ জোগানোর চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। গোটা দুনিয়ার সামনে বাংলাদেশ আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে।
কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দেশীয় দোসর রাজাকার ও আল-বদরদের হাতে নিহত ৩০ লাখেরও বেশি বাঙালি শহীদ আজও বিচার পাননি। জেনোসাইড বা গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে আমরা ব্যর্থ। শুধু তাই নয়, ঘটা করে জাতীয় গণহত্যা দিবস পালন করলেও পাকিস্তান আজও তাদের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি। মহামান্য রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোকে এ বিষয়ে বিশেষ তৎপর হতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীও কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে একাত্তরে গণহত্যার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করাটা প্রতিটি বাঙালীর জাতীয় কর্তব্য। পশ্চিমা বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন ইতিমধ্যেই সরব হয়েছে। আমাদেরও আরও সক্রিয় হয়ে জাতিসংঘকে বাধ্য করতে হবে ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস উপলক্ষে ঘোষণায়। সেটাই হবে শহীদদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.