সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণকে জটিল করে তুলেছে হামাসের হামলা

অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা শাসনকারী ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস ৭ অক্টোবর, শনিবার ভোরে ইসরায়েলে রকেট হামলা করেছে। একইসঙ্গে হামাস যোদ্ধারা সীমান্ত অতিক্রম করে দেশটিতে প্রবেশ করেছে। এরপর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার দেশের জনগণকে দীর্ঘ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। এই হামলার ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনা সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের আলোচনাকে জটিল করে তুলেছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গাজায় ইসরায়েলের হামলা

হামাসের এই আক্রমণটি ইসরায়েলি গোয়েন্দা পরিষেবাগুলোর ব্যর্থতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ইসরায়েলের অভ্যন্তরে এ রকম একটি হামলা হবে তা দেশটির গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ঘুর্নাক্ষরেও টের পায়নি। এমনকি এ ধরনের অভূতপূর্ব হামলার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও কোনো ধারণা ছিল না। 

যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য ভাগ করে নেয়। এছাড়া ইসরায়েলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো ছিল বলে মনে করেছিল ওয়াশিংটন।

এ রকম একটি পরিস্থিতি আব্রাহাম চুক্তির ধারাবাহিকতায় সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করতে সহায়তা করেছিল।

২০২০ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় আব্রাহাম চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন। এর মাধ্যমে দেশ দুটি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। পরবর্তীতে মরক্কো এবং সুদানও একই পথ অনুসরণ করে ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।  

প্রায় এক সপ্তাহ আগে, হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছিলেন, ‘দুই দশকের আগের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি বর্তমানে বেশ শান্ত। ফলে এ সময়েই সৌদি-ইসরায়েল শান্তি চুক্তির সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি রয়েছে।’

এদিকে শনিবার হামাসের হামলায় ১০০ জনেরও বেশি ইসরায়েলি সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। এছাড়া হামাস এবং ইসলামিক জিহাদ কয়েক ডজন ইসরায়েলিকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে গেছে। 

ইসরায়েল এই হামলার পর বড় ধরনের প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এরপর গাজায় বিমান হামলা করে দেশটি। তাদের এই হামলায় কমপক্ষে ১৯৮ জন বেসামরিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। 

এরই প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনের রামাল্লার একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক হানি এল মাসরি আমিরাতি পত্রিকা দ্য ন্যাশনালকে বলেছেন, ‘এই হামলা সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলেছে। এখন শিগগিরই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তি স্বাক্ষর করা সম্ভব হবে না।'  

তিনি জানিয়েছেন, হামাসের এই হামলার পর এখন আর কোনোভাবেই ফিলিস্তিনি সমস্যার সমাধান না করে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করা যাবে না।

প্রসঙ্গত, বিগত তিন দশক ধরে ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে তারা।  

শান্তি প্রতিষ্ঠায় মার্কিন এই ব্যর্থতা ফিলিস্তিনিদের ক্ষুব্ধ করেছে। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সামরিক উপস্থিতি ফিলিস্তিনিদের মধ্যে অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। এই পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েল এবং তার আরব প্রতিবেশীদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টাকে প্রভাবিত করেছিল।

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান গত মাসে একটি সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, সৌদি আরব এবং ইসরায়েলের মধ্যে একটি চুক্তি হলেও সেখানে ফিলিস্তিনিদের ওপর বিধিনিষেধ উঠিয়ে নেওয়ার শর্ত থাকবে। এই বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছুই বলেননি তিনি। ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী সরকার ফিলিস্তিনিদের ছাড় দিতে নারাজ হওয়ায় সৌদিরা আলোচনা স্থগিত করছে এমন খবর তিনি অস্বীকার করেছেন। 

অবশ্য মার্কিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী নীতির সাবেক উপ-সহকারী সচিব থমাস ওয়ারিক বলেছেন, সাম্প্রতিক এই সহিংসতা ভবিষ্যতের কৌশলগত চুক্তির ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে না।  

তবে সর্বশেষ হামলার ঘটনায় এই অঞ্চলে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে তা আরও তীব্র হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগে ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে লড়াইয়ের ফলে গাজায় ব্যাপক ধ্বংস এবং প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এখন ইসরায়েলে একটি অতি ডানপন্থী সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হবে বলে আশংকা করছেন অনেকেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফিলিস্তিনিদের সন্তুষ্ট করার জন্য আপাতত তাদের ভূমিতে ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণ পরিকল্পনা স্থগিত করতে হবে। তবে নেতানিয়াহুর সরকার এই দাবি মানতে নারাজ। এই সরকারের মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে বলেছেন, তারা পশ্চিম তীরে আরও ইহুদি বসতি স্থাপন করতে চান।      

ইসরায়েলের একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক আকিভা এলদার দ্য ন্যাশনালকে বলেছেন, ‘আগে যদি এটি কঠিন ছিল, তবে এখন এটি প্রায় অসম্ভব। কারণ ইসরায়েলি সরকার ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যে কোনো আপস করলে কট্টরপন্থীরা এর বিরোধিতা করবে। তারা বলবে মানুষ হত্যাকারী, সন্ত্রাসী হামাসকে পুরস্কৃত করা হচ্ছে।'  

তিনি জানিয়েছেন, সৌদিরা যেমন চাচ্ছে পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন বন্ধ করা, সেই পদক্ষেপ নেওয়াও এখন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে নেতানিয়াহুর সরকারের জন্য।

সূত্র: দ্য ন্যাশনাল