সাকিবদের ঐতিহাসিক জয়

সাকিব, সাকিব, সাকিব... সিলেটের নয়নাভিরাম প্রকৃতির সঙ্গে কানায় কানায় পূর্ণ গ্যালারি থেকে ভেসে আসা আওয়াজের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা এক দুর্দান্ত মুহূর্তকে আরও দুর্দান্ত করে তুলেছিলেন সাকিব আল হাসান। বিশ্বের সেরা লেগ স্পিনারকে লং অনের ওপর দিয়ে হাঁকানো সাকিবের ছক্কাটি ইএসপিএনে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল ‘The King Responds Perfectly.’

জয়ের পর শামিম পাটোয়ারীকে এভাবেই বাহবা দেন সাকিব

ওয়াফাদারের করা শর্ট বলে ড্রিপ মিড উইকেট দিয়ে সীমানা ছাড়া করার সাথে সাথে শামীমের উল্লাস। ততক্ষণে আফগানিস্তানকে প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি সিরিজ হারানোর টাটকা স্মৃতি নিয়ে শামীমকে আলিঙ্গন করে নিলেন অধিনায়ক সাকিব। আহ; অধিনায়ক তো এমনই হওয়া দরকার! এই দৃশ্যের আগে ঘটেছে নানান রোমাঞ্চ। মুজিব উর রহমানকে হাঁকানো আফিফের ছক্কা কিংবা তাসকিনের তাস'কিং রূপে আবির্ভাব হওয়া। মাঝে বৃষ্টির বাগড়া, পরের গল্পটা বাংলাদেশের, গল্পটা সুপার্ব সাকিবের।

১৬ জুলাই, রোববার সিলেটের সবুজ গালিচায় টস ভাগ্যে সাকিবের জয়। চেনা কন্ডিশনে কেন আগে বোলিং? উত্তরে সাকিব জানালেন, ‘তেমন কোনো কারণ নেই, তাড়া করতে চাই।’ সবশেষে সাকিব বললেন, দেখে মনে হয়েছে উইকেট ভালো!

সাকিবের শেষ কথাটি দূর থেকে হয়ত শুনে নিয়েছিলেন তাসকিন। শুরুটা করেন স্বপ্নের মতো। ম্যাচের প্রথম ওভারেই চেনা ভঙ্গিতে দেখা মেলে তাসকিনের। গুরবাজকে নিজের হাতে তালুবন্দি করার মধ্য দিয়ে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ৫০তম উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন।

উইকেটে গতি ছিল, বাউন্সের সঙ্গে মুভমেন্টও ছিল। তাসকিন ছুটলেন, বল ছুঁড়লেন গুডলেন্থে – অফ স্ট্যাম্পের বাইরের লাফিয়ে ওঠা বলটি জাজাই বুঝে ওঠার আগেই ব্যাটে চুম্বন খেয়ে বল লিটন দাসের গ্লাভসে। ক্যামেরার লেন্স ঘুরতেই তাসকিনের উল্লাস, উল্লাস লাল-সবুজের ভক্তদের।

তাসকিনের উল্লাসটা দীর্ঘ হয়নি, আকাশে তখন কালো মেঘের ঘনঘটা। এরই মাঝে পাওয়ার প্লে শেষ! দলীয় অষ্টম ওভারে সাকিবের আগমন, আগমন ঘটে বৃষ্টিরও। এ যেন এক অদ্ভুত দর্শন! বেশ জোরে ধেয়ে আসা বৃষ্টি চলল বেশ কিছুক্ষণ। কয়েক দফায় মাঠ পরিদর্শনের পর সিদ্ধান্ত এলো খেলা গড়াবে ১৭ ওভারে।

বৃষ্টির পর খেলা শুরু হলে সাকিব বাহিনী চেপে ধরে আফগান ব্যাটারদের। ক্যাপ্টেন লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্ট- বলছি ১১তম ওভারের কথা। সাকিবের স্পিন ঘূর্ণিতে জোড়া আঘাত আফগান শিবিরে। ১১ ওভার শেষে সফরকারীদের সংগ্রহ ৫ উইকেটে ৬৭ রান। এমন পরিস্থিতিতে একশ'র নিচে আটকে রাখার স্বপ্ন দেখছিল টাইগার সমর্থকরা। কিন্তু পেসারদের আগমনে বদলে যায় দৃশ্যপট। ১৫ ওভারেই দলীয় শতরান পেরিয়ে যায় আফগানরা। তাসকিন ও হাসান খরচ করেন ২ ওভারে ২৮ রান, এ যেন আগের ম্যাচের কার্বন কপি!

পরের গল্পে বাংলাদেশের ফেরা, মোস্তাফিজ ও তাসকিন শেষ ২ ওভারে দেন মাত্র ১০ রান, আফগানিস্তানের সংগ্রহ দাঁড়ায় ১১৬ রান। বাংলাদেশের সামনে জয়ের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ১১৭ রান।

লক্ষ্য ছোট। কিন্তু প্রশ্ন একটাই, ওপেনিংয়ে কে? –আফিফ? শান্ত? না অন্য কেউ?

উত্তর সামনে এলো লিটনের সঙ্গে আফিফকে দেখে। ততক্ষণে নষ্টালজিকে ফিরে যাওয়া বৈকি! রাজশাহীর জার্সিতে বিপিএলে লিটন–আফিফের ওপেনিং জুটি জাতীয় দলে দেখার স্বপ্ন যাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছিল, তারা এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। তেমনি আফিফ–লিটনও উজাড় করে দিয়েছেন নিজেদের।

৫০/০, ৫ ওভারের পাওয়ার প্লেতে লিটন–আফিফ জুটি ততক্ষণে মুগ্ধ করেছে টাইগার সমর্থকদের। তবে সেটি দীর্ঘ হয়নি, দলীয় দশম ওভারে মুজিবের জোড়া আঘাতে লিটন – আফিফ দু'জনেই ফেরেন সাজঘরে। ফেরার আগে মুজিবকে হাঁকানো আফিফের ছক্কাটি যেন নতুন এক বাংলাদেশের উত্থানের প্রতীক!

চারে তাওহীদ হৃদয়–কিছুটা অবাক লাগার কথা! অধিনায়ক সাকিব যে অন্যদের চেয়ে আলাদা সেটিরই যেন একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখলেন পরিকল্পনায়। হৃদয় সাকিবের পরিকল্পনাকে বড় করতে ব্যর্থ হলেও সাকিব যে বড় ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন ভালোভাবেই সেটি বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয় কারো।

পরের গল্পটা সাকিবের, গল্পটা ফিনিশার শামিমেরও! পিচের আচরণ, বলের গুণাগুণ, লেন্থের সঙ্গে সুইং মুভমেন্ট বুঝে ঠান্ডা মাথায় খেলে যাওয়া। অধিনায়ক সাকিবের সংস্পর্শে শামিমের ব্যাট মাত্রাতিরিক্ত সুইং না করলেও রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে সাকিবের পা জোড়া মাত্রাতিরিক্ত সুইং করেছে বটে! শেষ ৬ বলে ৪ রানের সমীকরণ মেলাতে কোনো নাটকের জন্ম হয়নি, শামিমের ব্যাটে বল সীমানা ছাড়া হতেই সাকিব এগিয়ে এসে শামিমকে দেন বাহবা।

এরই মাঝে হ্যাটট্রিক সিরিজ জয়ের রেকর্ড গড়ল বাংলাদেশ। হাথুরুসিংহের নতুন করে আগমনের পর সাকিবের নেতৃত্বে টানা ৩টি টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয় বাংলাদেশের। সাকিবের হাতে ম্যাচ ও টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার উঠতেই ইতিহাস দেয় উঁকি। বিশ্বের তৃতীয় সেরা ক্রিকেটার সাকিব, যার হাতে উঠেছে তৃতীয় সর্বোচ্চ টুর্নামেন্ট সেরার ট্রফি। সাকিবের সামনে শুধু কোহলি ও শচীন।

সবশেষে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সাকিবের কণ্ঠে যেটি ভেসে আসে সেটি আপনাকে মুগ্ধ করবে। যেভাবে মুগ্ধ করে চলছেন ৩৬ বছরে এসেও। সাকিব বলেন, ‘আজ আমি ও কোচিং স্টাফরা চেয়েছে তরুণরা বেশি সময় কাটাক এবং কাজ শেষ করে আসুক। এরপর (অবশ্য) আমাকে আসতে হয়েছে। আশা করি এ জয়ে পাওয়া আত্মবিশ্বাস সামনে এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপে কাজে দেবে।’