বিদায় জয়া, বিদায় সাঙ্গা

কোয়ার্টার ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ৯ উইকেটে বিদায় নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। একই সাথে বিদায় বলে দিয়েছেন ধ্রুপদি ব্যাটিংয়ের শেষ দুই প্রতিনিধি কুমার সাঙ্গাকারা ও মাহেলা জয়াবর্ধেনেও। লঙ্কান ক্রিকেটের দুই মহারথীকে রঙিন পোশাকে আর দেখা যাবে না। লঙ্কান ক্রিকেটের প্রতিশব্দ হয়ে উঠা এই দুই তারকা ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিলেন একসাথে। তাদের বিদায়ে কেবল শ্রীলঙ্কা নয়; বিশ্ব ক্রিকেটেই শূন্য হয়ে গেলো অনেকখানি।

এ বছরের শেষ দিকে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ খেলবে শ্রীলঙ্কা। ওই সিরিজের আগে স্কোয়াড তৈরির সময় নিঃসন্দেহে নস্টালজিয়ায় ভুগবেন নির্বাচকরা। হয়তো একটু বিব্রতও হবেন। শ্রীলঙ্কার দল ঘোষণা হবে, অথচ থাকবে না মাহেলা জয়াবর্ধনে ও কুমার সাঙ্গাকারা নাম দুটি!

গত এক দশকের বেশি সময় দলের তিন ও চার নম্বর জায়গা দুটি নিজেদের করে নিয়েছিলেন এই দুই কিংবদন্তী। চলতি শতাব্দিতে কুমার সাঙ্গাকারা ও জয়াবর্ধনের ব্যাটে ভর করেই তৈরি হয়েছে শ্রীলঙ্কার বেশিরভাগ ইনিংস।

এই দুইজনের ব্যাটে চড়ে একটি ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টির শিরোপা জিতেছে শ্রীলঙ্কা। দুই দুইবার খেলেছে ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনাল। ২০ মিলিয়ন মানুষের হৃদয়ের নায়ক হয়ে ছিলেন তারা।

এক সময় হেইডেন- ল্যাঙ্গার, গ্রিনিজ-হেইনস, ওয়ার্ন-ম্যাকগ্রার জুটি যেমন একটি শব্দের মতো হয়ে গিয়েছিলো, ঠিক তেমনটি কুমার-মাহেলা জুটিও পরিণত হয়েছিলো একটি শব্দে। লঙ্কান ভক্তদের কতোবার যে তারা জয়ের আনন্দে ভাসিয়েছেন, কতোবার যে এনে দিয়েছেন বুকের ছাতি উঁচু করা গর্বের উপলক্ষ।

একসাথে ৫৫০টি ম্যাচ খেলার পর অবশেষে ভাঙলো কুমারমাহেলা জুটি। কোয়ার্টারফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শেষবারের মতো একসাথে খেলে ফেলেছেন তারা। শেষ হয়ে গেলো শ্রীলঙ্কার ভিত্তি গড়ে দেওয়া জুটিও।

ক্রিকেটকে বিদায় বলার জন্য কোনো রকম চাপ ছিলো না তাদের উপর। তারপরও বিদায় বলে দিলেন তারা। গত দুই বছরে ৬৬ ওয়ানডেতে ৬০-এর একটু কম ছিলো সাঙ্গাকারার গড় রান। এর মধ্য ছিলো ১১টি সেঞ্চুরি, ২০টি হাফ সেঞ্চুরি। সব মিলিয়ে ৪০৩ ওয়ানডেতে সাঙ্গাকারার ব্যাট থেকে এসেছে ২৫টি সেঞ্চুরি, ৯৩টি হাফ সেঞ্চুরি, গড় ৪২। গত দুই বছরে টেস্টে তিনটি সেঞ্চুরি, দুটি ডাবল সেঞ্চুরি এবং একটি ট্রিপল সেঞ্চুরি এসেছে সাঙ্গার ব্যাট থেকে।

বিদায় বলার আগে শেষবারের মতো একবার বিশ্ব কাঁপিয়ে গেছেন সাঙ্গাকারা। ওয়ানডে ক্রিকেটে পরপর চার ম্যাচে সেঞ্চুরি করা প্রথম ও একমাত্র ব্যাটসম্যান তিনি। তাও বিশ্বকাপের মতো আসরে। 

জয়াবর্ধনেও ক্যারিয়ারের শেষ দুই বছরে দুর্দান্ত ছিলেন। এই বিশ্বকাপেও একটি সেঞ্চুরি করেছেন তিনি। আফগানিস্তানের বিপক্ষে শ্রীলঙ্কার দুর্বিসহ মুহূর্তে দারুণ এক সেঞ্চুরি বাঁচিয়েছেন দলকে। তার ১৯তম সেঞ্চুরির কল্যাণে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অঘটন থেকে থেকে বেঁচে গেছে বিশ্বকাপ।

সুতরাং ফর্মের কারণে নয়; বিখ্যাত এই দুই ব্যাটসম্যান বিদায় বললেন কেবল সময়ের প্রয়োজনেই। বিদায় বলতে হবে বলেই শেষবারের মতো গুডবাই বলে দিলেন তারা।

সাঙ্গাকারা নিজের বিদায় নিয়ে বলেন, 'অবসর ফর্মের বিষয় নয়। সময়ের প্রয়োজনে এবং সঠিক মনে হওয়াতেই বিদাল বলে দিলাম।'

ক্যারিয়ারে মোট ২৯৩বার একসাথে জুটি বেঁধেছেন সাঙ্গা-জয়া। তুলেছেন ১৩ হাজার ৩৬৮ রান। সেঞ্চুরি এসেছে ৩৬বার। হাফ সেঞ্চুরি ৬২বার। তাদের সবচেয়ে বিখ্যাত জুটি নয় বছর আগে কলম্বোতে। তিন দিনে ১৫৭ ওভার ব্যাটিং করে ৬২৪ রান তুলেছিলেন তারা। একজন করেছিলেন ৩৭৪ (মাহেলা) আরেকজন ২৮৭! ওই রেকর্ড ভাঙেনি আজও।

এই দুজনের জুটি যেনো সৃষ্টিকর্তাই ঠিক করে দিয়েছিলেন। ৩৮ বছর আগে পাঁচ মাসের ব্যবধানে দুজনের জন্ম। মাঠের ক্রিকেটের মতো মাঠের বাইরেও বড় জুটি তাদের। মিনিস্ট্রি অব ক্রাব নামে দুজনের একটি রেস্তোরার ব্যবসাও আছে কলম্বোতে। দুজনের বন্ধুত্বের বয়স দুই দশকেরও বেশি। তাদের জীবনের অর্ধেকেরও বেশিজুড়ে তারা!

শ্রীলঙ্কায় কিংবা বিশ্বের অন্য কোনো দেশে নিশ্চয় তাদের মানের ব্যাটসম্যান আসবে। কিন্তু সাঙ্গা-জয়া তাদের সময়ে যে প্রতাপ নিয়ে বাইশগজ শাসন করেছেন, ঠিক একই রকম জুটি কবে বিশ্ব দেখবে, তা এক বড় প্রশ্ন।

এই দুই ব্যাটিং মায়েস্ত্রোর বিদায়টা সুখকর হলো না। ক্রিকেট চাইলে আরো কিছুদিন তার কিংবদন্তী দুই নায়ককে আরো একটু হাসিমুখে বিদায় দিতে পারতো। কিন্তু তা হয়নি হারের নীল যন্ত্রণা নিয়েই শেষবারের মতো ক্রিকেট মাঠ থেকে জার্সি পড়ে বেরিয়ে গেছেন তারা। তাদের সাথে বেরিয়ে গেছে ধ্রুপদি ব্যাটিংয়ের শেষ দুই প্রতিনিধিও। বিদায় জয়া, বিদায় সাঙ্গা।

আপনি আরো পড়তে পারেন

সেমিতে দক্ষিণ আফ্রিকা

শোনা যাবে আম্পায়ারদের কথাও

সাকিবের কণ্ঠে সাহসের বাণী