ডলারের পরিবর্তে গোল্ড রিজার্ভে ঝুঁকছে বিশ্ব

রিজার্ভের মাধ্যম হিসেবে ডলারের চেয়ে গোল্ডের দিকে ঝুঁকছে বিভিন্ন দেশ। ফেব্রুয়ারি মাসে ৫৫ বছরের সর্বোচ্চ পরিমাণ স্বর্ণ কিনেছে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক মাসেই বিশ্বে রিজার্ভ হিসেবে রাখা গোল্ড বুলিয়নের পরিমাণ বেড়েছে ৫২ টন। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের সর্বসাম্প্রতিক উপাত্তে এ চিত্র দেখা গেছে।

ডলারের পরিবর্তে গোল্ড রিজার্ভে ঝুঁকছে অনেক দেশ

আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য-অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থার কারণে বিনিয়োগ ও সঞ্চয়ের নিরাপদ মাধ্যম খুঁজছে বিভিন্ন দেশ। আন্তঃদেশীয় লেনদেনে ডলারের বিকল্প খুঁজতে প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশের প্রয়াসের কারণে হুমকি দেখা দিয়েছে মার্কিন মুদ্রাটির আধিপত্যে। এসব কারণে অনেক দেশই রিজার্ভ সঞ্চয়ের মাধ্যম হিসেবে গোল্ডের দিকে ঝুঁকছে।

ফেব্রুয়ারিসহ টানা ১১ মাস কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর নীট গোল্ড ক্রয় বেড়েছে। চলতি বছরের প্রথম দুই মাস জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর নীট গোল্ড ক্রয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২৫ টনে। ২০১০ সালের পর গোল্ড বুলিয়নের জন্য এটাই কোনো বছরের সবচেয়ে জোরালো সূচনা।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য মতে, ফেব্রুয়ারি মাসে সর্বোচ্চ ২৪ দশমিক ৯ টন গোল্ড কিনেছে চীন। এ নিয়ে টানা চার মাস চীন গোল্ড ক্রয় করল। চার মাসে দেশটি নিজেদের গোল্ড রিজার্ভ ১০২ টন বাড়িয়েছে।

২০০২-২০১৯ সময়কালে চীন ১ হাজার ৪৪৮ টন গোল্ড রিজার্ভ বাড়িয়েছে। ২০১৯ সালের পর দেশটি হঠাৎ গোল্ড ক্রয় বন্ধ করে দেয়। ২০২২ সালের নভেম্বরে তারা আবার গোল্ড ক্রয় শুরু করে। ফেব্রুয়ারিতে কেনা ২৪ দশমিক ৯ টনসহ পিপলস ব্যাংক অব চায়নার মোট গোল্ড রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫০ টন।

ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৯ সালের পর থেকে নিরব সময়টিতে চীন হিসাব-বহির্ভূত গোল্ড ক্রয় অব্যাহত রেখেছিল, যা সে দেশের স্টেট এডমিনিস্ট্রেশন ফর ফরেন এক্সচেঞ্জ (সেফ) কর্তৃপক্ষের কাছে গচ্ছিত রয়েছে। চীন তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবের বাইরে বিকল্প রিজার্ভ হিসেবে সেফ-এ গোল্ড বুলিয়ন সংরক্ষণ করে বলে ধারণা করা হয়।

ফেব্রুয়ারি মাস শেষে রাশিয়ার গোল্ড রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩৩০ টন, যা জানুয়ারি শেষে দেশটির মোট গোল্ড হোল্ডিংয়ের তুলনায় ৩১ টন বেশি। মস্কোর হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে রাশিয়ার আন্তর্জাতিক রিজার্ভের ২৪ শতাংশ গোল্ড রিজার্ভ।

একইভাবে তুরস্কের আন্তর্জাতিক রিজার্ভের ৩৩ শতাংশ এখন গোল্ড রিজার্ভ। দেশটির গোল্ড রিজার্ভের মোট পরিমাণ এখন ৫৮৭ টন, যার মধ্যে ২২ টন যোগ হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে। টানা ১৫ মাস ধরে গোল্ড রিজার্ভ বাড়িয়ে চলেছে তুরস্ক।

মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তান ফেব্রুয়ারিতে ৮ টন গোল্ড বুলিয়ন ক্রয় করেছে। উজবেকিস্তানের গোল্ড রিজার্ভের পরিমাণ এখন ৩৯৩ টন, যা সে দেশের মোট আন্তর্জাতিক রিজার্ভের ৬৭ শতাংশ। পূর্ব এশিয়ার সিঙ্গাপুরের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেব্রুয়ারিতে ৭ টন বুলিয়ন ক্রয় করেছে। দেশটির মোট গোল্ড রিজার্ভ এখন ২০৫ টন, যা ২০২২ সালের শেষের তুলনায় ৫১ টন বেশি। একইভাবে, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ফেব্রুয়ারিতে নিজেদের গোল্ড রিজার্ভ ৩ টন বাড়িয়েছে। ভারতের মোট গোল্ড রিজার্ভ এখন ৭৯০ টন।

বিশ্লেষকদের মতে, ইউক্রেন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যে মেরুকরণ দেখা দিয়েছে, সেটাও ডলারের প্রতি বিমুখ করেছে অনেককে। যুক্তরাষ্ট্র ও সমমনা দেশগুলোর চাপ সত্ত্বেও রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে অথবা দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য-লেনদেন বন্ধে অনীহা দেখিয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলের বহু দেশ।

যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের কাছে থাকা রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ জব্দ করেছে। এ বিষয়টিও ডলারের বিষয়ে অনাগ্রহ বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলেই ডলারে লেনদেনে বিপত্তির মুখোমুখি হতে হবে, এমন ভাবনা জোরালো হয়েছে নীতি নির্ধারকদের মধ্যে।

ফেব্রুয়ারি মাসে গোল্ড বুলিয়নের নীট বিক্রেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কাজাখস্তান। ন্যাশনাল ব্যাংক অব কাজাখস্তানের গোল্ড রিজার্ভের পরিমাণ ফেব্রুয়ারিতে আগের মাসের তুলনায় ১৩ টন কমে ৩৪২ টনে নেমেছে। ফেব্রুয়ারিতে নীট গোল্ড বিক্রেতা দেশের তালিকায় আরও রয়েছে ক্রোয়েশিয়া। যদিও ইউরো জোনে যোগদানের শর্ত হিসেবে ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকে ২ টন বুলিয়ন স্থানান্তর করায় ক্রোয়েশিয়াকে এ তালিকায় রাখা হয়েছে।