‘ক্রিকেট পাগল’ মেহেদী মিরাজের উঠে আসার গল্প

অভাবের সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য জালাল সাহেব জীবনের তরী ভিড়ান শহরে। শুরু করেন মাইক্রোবাসের ড্রাইভারি। চোখে একমাত্র স্বপ্ন, দুটো সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলবেন। ছেলেকে স্কুলেও পাঠালেন। কিন্তু একি! পড়ালেখা যেমন তেমন, শাসন-বারণ সব তুচ্ছ করে ছেলে 'ক্রিকেট' নামে পাগল। একসময় জালাল হোসেন ছেলেটিকে আর বাধা দেননি। 'ছেলে যা চায়, করুক।' এই ছাড়ের ফলাফল পেতে সময় লেগেছে নামে মাত্র। ইংরেজদের টেস্টে হারিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে গৌরবের জয়টা ছিনিয়ে এনে দিয়েছেন জালাল সাহেবের 'অবাধ্য' ছেলে এই মেহেদীই।

জালাল হোসেনের জন্ম বরিশালের বাকেরগঞ্জের আউলিয়াপুর গ্রামে। চরম অভাব অনটনের এক পর্যায়ে ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে কাজের সন্ধানে জালাল হোসেন আসেন খুলনার খালিশপুরে। এরপর ড্রাইভিং শিখে রাস্তায় নামেন মাইক্রোবাস নিয়ে। ২০০০ সালের দিকে স্ত্রী ও দুই সন্তান মেহেদী ও মিম্মাকে নিয়ে আসেন খালিশপুরে। মেহেদী ভর্তি হন স্থানীয় কাশিপুর স্কুলে। পড়ালেখা বাদ দিয়ে মেহেদী ব্যাট বলে মত্ত। বাবার মনে নানা দুশ্চিন্তা ভর করে। ছেলে পড়ালেখায় মন না দিলে বড় মানুষ হতে পারবে না, খেলতে গিয়ে ছেলে যদি হাত-পা ভেঙে ফেলে তাহলে চিকিৎসা হবে কী করে? ক্রিকেট খেলতে অনেক টাকা প্রয়োজন, এতো টাকা কোথায় পাবেন তিনি! খেলার ভূত মাথা থেকে তাড়াতে হাত-পা বেঁধে বার কতোক মারও দেন ছেলেকে। কিন্তু বাধ সাধেন মেহেদীর মা মিনারা বেগম।

আরও একটু বড় হয়ে মেহেদী ভর্তি হন হাজী শরিয়তউল্লাহ বিদ্যাপীঠে। তার পাশে বিএল কলেজের মাঠে রোজ ছেলেরা ক্রিকেট খেলে। মেহেদী প্রায়ই দাঁড়িয়ে খেলা দেখে। এমনই একদিন মাঠে দাঁড়িয়ে আছে মেহেদী, হঠাৎ মাঠের একপ্রান্ত থেকে হাওয়ার বেগে ছুটতে ছুটতে এগিয়ে আসছিল একটি বল। বিশেষ কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই বলটি মেহেদী মুঠোয় নিয়ে নেন। কোচ আল মাহমুদ প্রিন্স মেহেদীকে বিচার করতে এটুকু সময়ই নিয়েছিলেন। ‘তুমি প্র্যাকটিস করো।’ মেহেদীকে প্রিন্স বললেন।

এরই মধ্যে প্রিন্স বাড়ি এসে মেহেদীর মাকে বোঝান, ‘ছেলেটি ক্রিকেট বোঝে, ভালো খেলেও। এই ছেলে একদিন নাম করবে। বড় খেলোয়াড় হবে। আপনারা ওকে বাধা দেবেন না। ব্যাট, প্যাড, গ্লাভস, জুতা—যা লাগে আমরাই জোগাড় করে দেব।’ এভাবেই শুরুটা হয়। ধীরে ধীরে নানাজনের প্রশংসা ও আশার বাণীতে বাবা জালাল হোসেনে নমনীয় হন।

মেহেদীর প্রশিক্ষণ শুরু হয় কাশিপুর ক্রিকেট একাডেমিতে। বয়সভিত্তিক খেলায় মেধা-যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে মেহেদী পৌঁছে যায় অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। চলতি বছরের শুরুর দিকে ঢাকায় অনুষ্ঠিত যুব বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দেন। দলকে চ্যাম্পিয়ন করতে না পারলেও তিনিই হন টুর্নামেন্ট সেরা।

তারপর আট মাস পর ডাক আসে জাতীয় দলের, সরাসরি টেস্টে। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে খেলতে নামেন মেহেদী হাসান মিরাজ। তারপরই গড়েন নিজের ইতিহাস। চট্টগ্রাম টেস্টে সাত উইকেট, ঢাকা টেস্টে ১২ উইকেট; দুই টেস্টে ১৯ উইকেট নিয়ে সিরিজ সেরা। এরপর টেস্টে ইংরেজদের হারিয়ে খালিশপুরের সেই ছোট্ট মেহেদী বনে যায় তারকা!

তারপর থেকেই মেহেদীর পরিবারের ঠিকানা খালিশপুরের ছোট একটি খুপরিতে একে একে দেশের নানা স্থান থেকে ভক্তরা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে এসে মিরাজের মা-বাবা-বোনকে শুভেচ্ছা জানিয়ে যাচ্ছে। মিরাজের ছোট্ট ঘরে এত অতিথিকে বসতে দেওয়ার জায়গা নেই, তাই সামনের খোলা চত্বরেই চেয়ার দিয়ে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

জামাল হোসেনের ১০ মাস আগে কিডনিতে অপারেশন হয়েছে। তিনি এখন আর গাড়ি চালান না। মা মিনারা বেগম গৃহিণী। একমাত্র বোন রুমানা আক্তার মিম্মার আনন্দের কোন সীমা নেই। মিরাজের দাদি জবেদা বিবি। তিনিও নাতির খেলা দেখেন, তবে অন্যের ঘরে।

জবেদা বিবি বলেন, ‘মোগে বাড়িতে কারেন্ট নাই। হ্যার পরও নাতির খ্যালা দেখছি প্যাদা বাড়িতে যাইয়া। শুক্রবারই নাতি টিভি পাঠাইছে, ঘরে কারেন্ট নাই।’

গত সোমবার মিরাজের বাবা বলেন, ‘ছেলের এই সাফল্যে শুধু খুলনা নয়, সারা দেশের মানুষ আনন্দিত। মিরাজের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমি টিভিতে ছেলের খেলা দেখেছি। খুব ভালো লেগেছে।’ তিনি ছেলের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। 

আপনি আরও পড়তে পারেন

মিরাজের সঙ্গে খেলতে খেলতে চান ড্যারেন স্যামি

স্টোকসকে কেন স্যালুট দিয়েছিলেন সাকিব?

বোথাম: বাংলাদেশ পারলে বিদেশের মাটিতে জিতে দেখাক

বাংলাদেশের কাছে হেরে ‘লজ্জা’য় মরে যাচ্ছে ইংলিশ মিডিয়া

ভারতীয় মিডিয়া: অটো চালকের ছেলের হাতে ইংল্যান্ড হেরে গেল!